বাংলাদেশে যদিও করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমেনি, তবুও দেশ প্রাণবন্ত এবং সোস্যাল মিডিয়া সজীব রয়েছে। মিডিয়ার সাম্প্রতিককালের আগ্রহের বিষয় হলো কোভিড-কেন্দ্রীক দুর্নীতি, যার সাথে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। দুটো প্রতিষ্ঠানই নমুনা সংগ্রহ, ভুয়া পরীক্ষা চালানো এবং মিথ্যা সার্টিফিকেট দেয়ার সাথে জড়িত ছিল।
জেকেজির ঘটনায় এক সুদর্শন নারী ডাক্তারও জড়িত ছিলেন। ন্যাশনাল কার্ডিয়াক হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন তিনি। তার ছবি ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে গেছে এবং তাকে নিয়ে যে সব মন্তব্য করা হচ্ছে, সেগুলোর অনেকগুলোই যৌন বিষয়ক ও ছেলেমানুষি।
রিজেন্ট হাসপাতালের শাহেদের ব্যাপারে মন্তব্য অবিশ্বাস্যরকম কঠোর কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের (এএল) প্রতিনিধি হিসেবে মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি, এখন যাকে প্রতারক হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। টিভিতে আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে অনুষ্ঠিত বিতর্কগুলোতে তিনি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকে সমর্থন করতেন। হঠাৎ করেই সেই জায়গা থেকে তার পতন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, কেন এটা হয়েছে, সেটা নিয়ে অনেক কৌতুহল রয়েছে।
গতানুগতিক মিডিয়া ঢিলেমি:
গতানুগতিক মিডিয়াগুলোর ঢিলেমি এবং তাদের সাথে বিনিময়ের সুযোগ না থাকায় জনগণের অংশগ্রহণ সেখানে অসম্ভব। কোন প্রতিষ্ঠান বা সিস্টেম না থাকার কারণে সোস্যাল মিডিয়া এখন বিরাট উন্মুক্ত জায়গা হয়ে গেছে যেখানে বাংলাদেশীরা কথা বলতে পারে এবং নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে। একটা বিকল্প জাতীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এটা, যেখানে যে কেউ যে কাউকে টার্গেট করতে পারে।
নারী ডাক্তার সাবরিনা ব্যাপক মনোযোগের আকর্ষণ করেছেন কারণ তাকে গ্ল্যামারাস মনে করা হয়েছে। তার ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। কিভাবে এই ছবিগুলো সংগ্রহ করা হলো, সেটা জানা না গেলেও সেগুলো ভাইরাল হয়ে গেছে।
এদিকে, সাবরিনা দ্রুত তার স্বামী আরিফকে তালাক দিয়ে দিয়েছে, যে জেকেজি মামলায় প্রধান অভিযুক্ত। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এটা পরিস্কার যে, সরকার তাকে আর আরিফকে নিয়ে একটা মামলা তৈরি করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রের কাস্টডিতে একে অন্যের বিরুদ্ধে দোষারোপে ব্যস্ত ছিল এই দম্পতি। সোস্যাল মিডিয়াও বিষয়টি নিয়ে জল্পনা কল্পনার মধ্যে একই রকম ব্যস্ত ছিল এবং মনোযোগের বেশির ভাগই ছিল সাবরিনার দিকে। একজন নারী মন্তব্য করেছেন, “সে দেখতে ভালো, সে কারণে পুরুষের আগ্রহ তার দিকে। কিন্তু আরিফ দেখতে অনাকর্ষণীয় বেকুবের মতো, সে কারণে নারীরা তার ব্যাপারে আগ্রহী নয়!”
রিজেন্ট ধামাকা:
এদিকে, সাহেদ আর তার রিজেন্ট হাসপাতালকে কেন্দ্র করে বড় মামলাটি নতুন পর্যায়ে চলে গেছে। কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছে যে, সাহেদ একের পর এক অপরাধ করেছে। মানুষকে নিজের গাড়ি দিয়ে চাপা দিয়ে এবং এরপর তাদেরকে রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়ে তাদেরকে বিশাল বিল ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে সে প্রায় পৌরানিক শয়তানি চরিত্র হয়ে উঠেছিল।
তবে, এই সবাইকেই মাথায় রেখে একটি প্রশ্ন করেছে সোস্যাল মিডিয়া। “সরকার কি কখনও জানতো না যে সে একজন অপরাধী ছিল?” মিডিয়াসহ সব জায়গাতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিত্ব করেছে সাহেদ। তাহলে কিভাবে সে পার পেয়ে গেলো? সোস্যাল মিডিয়ায় এমন ধারণা পোষণ করা হচ্ছে যে, কোন একটা গোলমাল হয়েছিল, সম্ভবত সে কাউকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করেছিল বা বড় কাউকে আঘাত দিয়েছিল এবং সে কারণে তাকে এখন টেনে নামানো হয়েছে।
আর এরপর আসলো ছবির বন্যা। প্রায় সবার সাথেই ছবি রয়েছে শাহেদের। এর মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, মিডিয়া সিইও এবং বাকি অন্যরা। এই সব ফটোতে থাকা সবাইকেই সমালোচনা করে ব্যস্ত সময় পার করেছে সোস্যাল মিডিয়া।
মিডিয়ার সাহেদ:
একটি অনলাইন প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক ছিলেন সাহেদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে তাকে প্রায় সব সময়ই টিভি টক শোতে দেখা যেতো। আওয়ামী লীগপন্থী মিডিয়াগুলোর জন্য সে ছিল খুবই স্বাভাবিক অতিথি। সে কারণে সোস্যাল মিডিয়া – পেশাদার মিডিয়ার সাথে যাদের ভালোবাসা-ঘৃণার সম্পর্ক, তারা এখন সম্ভাব্য সকল অপরাধের জন্য এই মিডিয়াগুলোকেও দুষছে। একজন ব্যক্তি, যে কিনা প্রতারণার মামলায় জেল খেটেছে, তার বিরুদ্ধে ৩২টির বেশি মামলা রয়েছে, তাকে কিভাবে এত কিছু করতে দেয়া হলো। নিরাপত্তা যাচাইয়ের কেউ কি ছিল না?
গ্রেফতার এবং বিদ্রুপ:
এদিকে, এই সব কিছু ফাঁস হওয়ার পরে আত্মগোপনে যান সাহেদ। কিন্তু কিংবদন্তী র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়নের (র্যাব) যখন তাকে ধরতে পুরো এক সপ্তাহ লাগিয়ে দেয়, তখন আরও অনেক প্রশ্ন ওঠে বিষয়টি নিয়ে। এটা পরিস্কার যে সে লুকিয়েছিল, পালানোর চেষ্টা করেছিল এবং সীমান্ত পার হওয়ার ঠিক আগে সে ধরা পড়ে।
কিন্তু অনেকের কাছেই এই গ্রেফতার প্রক্রিয়াটা সাজানো মনে হয়েছে। এমনকি হাতে হ্যাণ্ডকাফ পরা থাকলেও তার কোমড়ে পিস্তল ঝুলছিল, যেটা নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠেছে। বহু ডজন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ দিয়ে সোস্যাল মিডিয়া ভেসে গেছে এবং হাসাহাসির ইমোজিরও কোন কমতি নেই। র্যাব ডিরেক্টর জেনারেল মিডিয়াকে বলেছেন যে, তিনি জানেন না একজন ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার পরে কিভাবে তার কাছে পিস্তল থাকতে পারে। তাকে গ্রেফতার করে যে ধরনের সুবিধার প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটা তাই আসেনি।
তবে, যে স্মার্ট র্যাব কর্মকর্তা সাহেদকে গ্রেফতার করেছে, তিনি নারীদের মনোযোগের বিষয় হয়ে উঠেছেন। আর সব ধরনের ছবি, সংবাদ ব্যঙ্গ, ভুয়া খবর ইত্যাদি মিলিয়ে সোস্যাল মিডিয়ার এক ব্যক্তি যৌক্তিকভাবেই যে উপসংহারে পৌঁছেছেন, সেটা হলো তার মনে হচ্ছে যেন সরকার সাহেদ আর সাবরিনার বিয়ে দিয়ে দেবে!
পুরো এই পর্বটির যুক্তিহীনতা এবং দুর্নীতির ধারাটা সোস্যাল মিডিয়ায় মন্তব্যে আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে ভালো প্রতিফলিত হয়েছে, যেটা গতানুগতিক মিডিয়ার রিপোর্টে হয়নি।
Leave a Reply