৫ আগস্ট ২০২০ হলো জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা বিষয়ে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ ও ধারা ৩৫/এ বাতিলের এক বছর পুর্তি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধিন ভারত সরকার অঞ্চলটিকে দ্বিখণ্ডিত করে দু’টি ইউনিয়ন টেরিটরিতে (জম্মু-কাশ্মীর ও লাদখ) পরিণত করে। এর মাধ্যমে অঞ্চলটিকে নয়া দিল্লীর সরাসরি শাসনে নিয়ে আসা হয়।
এটা ছিলো এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। এর পর থেকে অশান্ত ভারতীয় সমাজ আরো অশান্ত হয়েছে, আগে থেকে বিভক্ত ভারতীয় সমাজে বিভক্তি আরো বেড়েছে, আর দ্রুত প্রবৃদ্ধির পথে অগ্রসরমান ভারতীয় অর্থনীতির পতন শুরু হয়।
জম্মু-কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল আসলে ভারতের বহু-দশকের লালিত সম্প্রসারণবাদি মনোভাবে ফল। ১৯৭০র-এর দশকে ভারত পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়। এরপর সিকিমকে বলপূর্বক দখল করে। ভুটান কার্যত একটি উপনিবেশের মতোই ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে নিজের প্রভাব বলয় মনে করে এবং নেপালকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে।
ভারত অধিকৃত অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করতে লাদাখ-কে ইউনিয়ন টেরিটরি হিসেবে ঘোষণা করে। এটা চীনের বিপরতীতে কথিত ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ বাস্তবায়নের চেষ্টা এবং তারা চীনের ভূখণ্ডও দখল করতে থাকে।
এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পেছনে মৌলিক চলকগুলো হলো ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ।
ভারত নিজেকে মনে করে এই অঞ্চলের প্রভু। কেউ তাকে না মানলে ওই দেশে তারা সমস্যা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে অভিন্ন গন্তব্যের পথে হাটতে চায় চীন। চায় একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ভারতকেও বাইরে রাখতে চায় না। কিন্তু ভারত মনে করে এতে তার আধিপত্যের অবস্থানটি খর্ব হবে।
কট্টর জাতীয়তাবাদের কারণে গত দুই বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সামরিক সংঘাত লেগেই আছে। নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কে গুরুতর ফাটল দেখা যাচ্ছে। ভুটানও ভারতের ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ শুরু করেছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অবস্থা:
রাজ্য-মর্যাদা বাতিলের পর থেকেই কাশ্মীরীরা বয়কট ও প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। মহামারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ও ‘অর্থনৈতিক মিরাকল’ ব্যর্থ হওয়ার পরও মোদি প্রশাসন কাশ্মীরে বড় আকারের সামরিক দমন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে কাশ্মীর এখন উত্তপ্ত বারুদ, সারা দেশে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত উষ্কে দিচ্ছে। সামাজিক অসন্তোষের নতুন যুগে প্রবেশ করছে ভারত।
কাশ্মীরে সব মিলিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর নয় লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। চলাচল ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত স্থানীয় জনগণ। কাশ্মীরের টেলিফোন নেটওয়ার্কের উপর ব্যাপকভিত্তিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। বাইরের বিশ্ব থেকে কাশ্মীরকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়াই বলছে যে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট করা তাদের জন্য দিনে দিনে আরো দুরহ হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কাশ্মীরে অনেক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী অন্তত ২১০টি সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এই সময়ে ৫০টি বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এতে ১২৪ জন নিহত, ১৩৬ জঙ্গিকে আটক ও ১৭টি গেরিলা আস্তানা ধ্বংস করা হয়েছে।
গত একটি বছর ধরে কাশ্মীরবাসীর স্বাভাবিক কোন জীবন নেই। এতে ভারত সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ চরমে পৌছেছে। গত ৭ মে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ডন-এর এক রিপোর্টে বলা হয়ছে, প্রায় দুই লাখ কাশ্মীরী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হাজার হাজার কাশ্মীরী লাঠিসোটা, পাথর ও এরকম জিনিস নিয়ে ভারতীয় সেনাদের সাঁজোয়া যানে হামলা চালায়। জবাবে বিক্ষোভকারীদের প্রতি গুলি চালায় ভারতীয় সেনারা।
কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ:
কাশ্মীর ইস্যু এক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে কাশ্মীরকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিরোধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতিসংঘ সনদ, নিরাপত্তা পরিষদের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলোর ভিত্তিতেই কাশ্মীর সমস্যা সঠিকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যমতও এটাই।
কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের বহু প্রস্তাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ গণভোটের যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিলো ভারত তা প্রত্যাখ্যান করার কারণেই অধিকৃত কাশ্মীরে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে পাকিস্তান মনে করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোতে বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীর বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার আগে ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের মর্যাদার ব্যাপারে কোন বস্তুগত পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। কাশ্মীরের বেশিরভাগ মানুষ কি চায় তা নির্ধারণের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোট আয়োজনের মধ্য দিয়ে জম্মু-কাশ্মীর বিরোধ নিষ্পত্তির পথ বাতলানো হয়েছে জাতিসংঘ প্রস্তাবে। (সূত্র: ইন্টারনেট)
Leave a Reply